সোনাগাজী: সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে চরের জনপ্রতিরক্ষা অসম্ভব!

সোনাগাজী একটি আদর্শ গ্রাম, এবং চর চান্দিয়ার সবুজ বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল। এখানে এক সময় ধানের চাষ হতো, বিচরণ করতো গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া। স্থানীয়দের মৎস্য আহরণের উৎসও ছিল এই চরাঞ্চল। চাষাবাদের সম্ভাবনা ছিল তরমুজের মতো ফলসহ বিভিন্ন ধরনের সবজির। কিন্তু কৃষির অপার সম্ভাবনার এই চরে গড়ে তোলা হয়েছে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প। উৎপাদিত এই বিদ্যুৎ আলো ছড়ানোর কথা থাকলেও স্থানীয়রা বলছেন, ছিটেফোঁটাও মিলছে না তাদের ভাগ্যে। অমিত সম্ভাবনার কথা বলা হলেও এই প্রকল্প এখন যেন স্থানীয়দের জন্য বিষফোঁড়া।

স্থানীয় কৃষক, মৎস্যজীবী ও সাধারণ মানুষ বলছেন, তারা ফসল উৎপাদন ও পশুপালন করতে পারছেন না। এমনকি তারা মাছ ধরার অধিকারও হারিয়েছেন। স্থানীয়দের অনেকেই বাধ্য হয়ে প্রকল্পের জন্য জমি ছেড়ে দিয়েছেন। প্রকল্প এলাকার গ্রাম ও আশপাশের ১০ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। প্রকল্পে তাদের যে চাকরি বা কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তার কোনো বাস্তবায়ন হয়নি।

ইকবাল হোসেন হেলাল নামে স্থানীয় এক কৃষক বলেন, এই গ্রাম ও আশপাশের ১০ হাজার পরিবার এই সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত। এই চরে এক সময় ধান হতো। মাছের মৌসুমে মাছ থাকতো। চরের জমিতে বিচরণ করতো গবাদি পশু। এখন কিছুই করার নেই। মানুষ হয়ে পড়েছে কর্মহীন।

আবদুল খালেক নামে একজন বাথান মালিক জানান, এই চরই ছিল তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বর্ষাকালে কোটি টাকার মাছ আহরণ করা যেত। ইরি-বোরো ধানের মৌসুমে উৎপাদন হতো কয়েকশ টন ধান। সব শেষ এখন। মানুষ যে কিছু করে খাবে তার আর উপায় নেই।

সোনাগাজী উপজেলায় ৭৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে এক হাজার এককর জমির ওপর। ২০২১ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পটি ২০২৪ সালের এপ্রিল থেকে উৎপাদনে এসেছে। চীনের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ (ইজিসিবি)। ব্যয় হয়েছে ৭৫৬ কোটি ৭৬ লাখ টাকা, যার অর্থায়ন করেছে বিশ্বব্যাংক, বাংলাদেশ সরকার ও ইজিসিবি।

বর্তমানে সেখানে আরও একটি ২২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে, যার জন্য অতিরিক্ত প্রায় ৭০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে। এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২১৩৩ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। প্রস্তাবটি ইতোমধ্যে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।

প্রকল্পটির উপ-সহকারী প্রকৌশলী রুবেল চন্দ্র দাস বলেন, পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়নের পরই এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। বিশাল চরাঞ্চল হওয়ায় এখানে প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে।

তবে বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। স্থানীয় কৃষক, মৎস্যজীবী ও সাধারণ মানুষ বলছেন, সোনাগাজী সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে তারা কৃষি, পশুপালন ও মাছ ধরার অধিকার হারিয়েছেন। চরজুড়ে একসময় ধান, তরমুজ ও অন্যান্য সবজি চাষ হতো। বর্ষাকালে আহরণ করা যেত কোটি টাকার মাছ। গরু-মহিষ চরতো স্বাধীনভাবে। এখন সবই বন্ধ।

স্থানীয়রা অভিযোগ করছেন, প্রকল্পের সময় চাকরির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও বাস্তবে স্থানীয় কেউ কাজ পাননি। এমনকি একজন দারোয়ানও নয়।

জানা গেছে, জমি অধিগ্রহণের সময় মৌজার রেট অনুযায়ী জমি মালিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। চরে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করছেন স্থানীয় বিশিষ্টজনেরা।

সোনাগাজী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাইন উদ্দিন আহমেদ বলেন, ফেনীর সোনাগাজী আদর্শ গ্রামের এই চর ও চর চান্দিয়ার চরগুলোয় বোরো ধান আবাদ হয়। এছাড়া কিছু জমিতে তরমুজের আবাদও ভালো হয়। এছাড়াও বর্ষা মৌসুমে স্থানীয়রা এখানে মৎস্য আহরণ করতো। গরু-মহিষসহ সব ধরনের গবাদি পশু পালনেও এই চরাঞ্চল ইতিবাচক ভূমিকা রাখতো। সব মিলিয়ে এই চরাঞ্চলকে কৃষির জন্য উর্বর ভূমি বলা যায়।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সোনাগাজী উপজেলা সভাপতি শেখ আবদুল হান্নান বলেন, যেখানে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হয়েছে সেটি ছিল একটি উর্বর চর। যেখানে যেমন চাষাবাদ হতো তেমনি বর্ষা মৌসুমে হতো মাছের বিচরণ। গবাদি পশু লালন-